img

গার্হস্থ্য সহিংসতা এবং কলঙ্ক

প্রকাশিত :  ১৫:২৪, ২১ ডিসেম্বর ২০২৩

গার্হস্থ্য সহিংসতা এবং কলঙ্ক

বিশ্বব্যাপী নারীদের প্রতি পরিচালিত সহিংসতা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং প্রতিরোধ করার জন্য প্রতি বছর ২৫শে নভেম্বর বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক দিবসটি পালিত হয়। লিঙ্গ—ভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে ১৬ দিনের সক্রিয়তা অভিযান শুরু হয় ২৫শে নভেম্বর এবং ১০ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবস পর্যন্ত চলে, যা নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও নির্মূল করার আহ্বান জানায়।

লিঙ্গ—ভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে ১৬ দিনের এই সক্রিয়তা অভিযান উপলক্ষে আমার এই নিবন্ধটির লক্ষ্য এশিয়ান পরিবারের মধ্যে গার্হস্থ্য সহিংসতা এবং সাংস্কৃতিক কলঙ্কের জটিল সংযোগের উপর আলোকপাত করা, সচেতনতা, সমর্থন এবং সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেওয়া।

দুর্ভাগ্যবশত, গার্হস্থ্য সহিংসতা (ডোমেস্টিক ভায়োলান্স) একটি জীবন্ত দুঃস্বপ্ন যা আক্ষরিক অর্থে প্রতিদিন কয়েক’শ হাজার মানুষ অনুভব করে। যে কেউ গার্হস্থ্য সহিংসতার শিকার হতে পারে, তবে কিছু লোক — বিশেষ করে মহিলাদের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। গার্হস্থ্য সহিংসতা সাধারণত এক সঙ্গীর দ্বারা অন্য সঙ্গীর ধারাবাহিক এবং পদ্ধতিগত নিয়ন্ত্রণ এবং অপব্যবহার। এতে শারীরিক, যৌন, আর্থিক এবং মানসিক সহিংসতা সহ বিভিন্ন ধরনের অপমানজনক আচরণ জড়িত থাকতে পারে। গার্হস্থ্য সহিংসতা লিঙ্গ, বয়স, জাতিগত, যৌন অভিমুখীতা, ধর্ম বা আয় নির্বিশেষে সমস্ত আর্থ—সামাজিক গোষ্ঠীতে ঘটে। এর ব্যাপকতা থাকা সত্ত্বেও, গার্হস্থ্য সহিংসতা (ডোমেস্টিক ভায়োলান্স) প্রায়শই কলঙ্কের একটি ভারী বোঝা বহন করে, যা গার্হস্থ্য সহিংসতা থেকে বেঁচে থাকাদের মুখোমুখি হওয়া চ্যালেঞ্জগুলিকে আরও জটিল করে তোলে।

গার্হস্থ্য সহিংসতা একটি বিস্তৃত সমস্যা যা সীমানা এবং সংস্কৃতিকে অতিক্রম করে, সারা বিশ্বে জীবনকে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে এশিয়ান পরিবারগুলির প্রেক্ষাপটে, গার্হস্থ্য সহিংসতার ব্যাপকতা প্রায়ই নীরবতা এবং কলঙ্কে আবৃত থাকে।

সাংস্কৃতিক গতিশীলতাঃ এশিয়ান সংস্কৃতিগুলি প্রায়ই শক্তিশালী পারিবারিক বন্ধন, পিতৃতান্ত্রিক নিয়ম এবং পারিবারিক সম্মান রক্ষার উপর সম্মিলিত জোর দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। এই সাংস্কৃতিক গতিশীলতা গার্হস্থ্য সহিংসতার স্থায়ীকরণে অবদান রাখতে পারে এবং এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে পারে যেখানে ভুক্তভোগীরা লজ্জা বা কলঙ্ক এবং বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে কথা বলতে অনিচ্ছুক।

নীরব কষ্টঃ এশীয়ান পরিবারগুলিতে গার্হস্থ্য সহিংসতা মোকাবেলায় প্রধান চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে একটি হল সমস্যাটিকে ঘিরে বিদ্যমান নীরবতা। ভুক্তভোগীরা তাদের পরিবারের লজ্জা এড়াতে, সহিংসতার চক্রকে শক্তিশালী করতে নীরবে নির্যাতন সহ্য করতে পারে। বিবাহবিচ্ছেদ বা অপব্যবহারের অভিযোগের সাথে যুক্ত কলঙ্ক ব্যক্তিদের সাহায্য চাইতে বাধা দিতে পারে ও গোপনীয়তার সংস্কৃতিকে স্থায়ী করে।


গার্হস্থ্য সহিংসতাকে ঘিরে কলঙ্ক বহুমুখী। একটি দিক হলো সামাজিক উপলব্ধি জড়িত যা ভিকটিমদের দোষারোপ করে, তাদের পছন্দকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বা ক্ষতিকারক স্টেরিওটাইপগুলিকে শক্তিশালী করে।

এই ধরনের দোষারুপ সূক্ষ্ম উপায়ে প্রকাশ হতে পারে, যেমন ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করার ভাষা বা মনোভাবে বুঝানোর চেষ্টা করা হয় যে তাদের সহ্য করা নির্যাতনের ও অপব্যবহারের জন্য কোনো না কোনোভাবে ভুক্তভোগীরাই দায়ী। এই ধরনের কলঙ্ক ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের সাহায্য চাইতে, বিচারের ভয় এবং বিচ্ছিন্নতা থেকে বিরত রাখতে পারে।

সামাজিক কলঙ্ক ছাড়াও, পরিবার এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রায়ই গোপনীয়তার আবরণ থাকে, যা নীরবতার একটি চক্রকে স্থায়ী করে। সারভাইভ করা ব্যক্তিরা আরও ভিকটিম হওয়ার ভয়ে বা সামাজিক কাঠামোর সম্ভাব্য ভাঙ্গনের কারণে তাদের অভিজ্ঞতা লুকিয়ে রাখতে বাধ্যতা বোধ করতে পারে। এই নীরবতা এমন একটি পরিবেশকে উৎসাহিত করে যেখানে অপব্যবহার সনাক্ত না করা যেতে পারে, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং সহায়তা ব্যবস্থা বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করে।

সম্প্রদায়ের কলঙ্কঃ গার্হস্থ্য সহিংসতার সাথে জড়িত কলঙ্ক শুধুমাত্র বেঁচে থাকা ব্যক্তিরা অনুভব করেন না বরং এটি বৃহত্তর সম্প্রদায়ের মধ্যেও প্রসারিত হয়। খ্যাতি এবং সামাজিক বিচার সম্পর্কে উদ্বেগ প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের হস্তক্ষেপ বা সন্দেহজনক অপব্যবহারের প্রতিবেদন করা থেকে নিরুৎসাহিত করতে পারে। এই সম্মিলিত নীরবতা এই ধারণাটিকে স্থায়ী করে যে গার্হস্থ্য সহিংসতা একটি ব্যক্তিগত বিষয়, এই সামাজিক অসুস্থতা নির্মূলে অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করে।

ভিকটিমদের উপর প্রভাবঃ গার্হস্থ্য সহিংসতা থেকে বেঁচে যাওয়াদের উপর কলঙ্কের প্রভাব তাৎক্ষণিক সামাজিক প্রতিক্রিয়ার বাইরে প্রসারিত। এটি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকেও প্রভাবিত করতে পারে, লজ্জা, অপরাধবোধ এবং বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি বাড়িয়ে তুলতে পারে। এশিয়ান সম্প্রদায়ের গার্হস্থ্য সহিংসতার আশেপাশের কলঙ্ক বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের আরও বিচ্ছিন্ন করতে পারে, তাদের সহায়তা চাওয়ার এবং অপব্যবহারের চক্র থেকে মুক্ত হওয়ার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

নীরবতা ভাঙাঃ গার্হস্থ্য সহিংসতার সাথে যুক্ত কলঙ্ক মোকাবেলার জন্য একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন।

স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক এবং পারিবারিক গতিশীলতা সম্পর্কে সচেতনতা, শিক্ষা এবং উন্মুক্ত সংলাপকে উৎসাহিত করে এমন উদ্যোগগুলি নীরবতা ভাঙতে সাহায্য করতে পারে। সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীল সহায়তা পরিষেবাগুলি অবশ্যই শিকার এবং বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের সহায়তা প্রদানের জন্য উপলব্ধ করা উচিত, তারা যে অনন্য চ্যালেঞ্জগুলির মুখোমুখি হতে পারে তা স্বীকার করে।

শিক্ষা অপব্যবহারের আশেপাশের মিথ এবং ভ্রান্ত ধারণাগুলি দূর করতে, সহানুভূতি বাড়ানো এবং সমর্থনের সংস্কৃতি প্রচারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জনসচেতনতামূলক প্রচারণা স্টেরিওটাইপকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এবং খোলামেলা কথোপকথনকে উৎসাহিত করতে পারে, এমন একটি পরিবেশ তৈরি করে যেখানে বেঁচে থাকা ব্যক্তিরা বিচারের ভয় ছাড়াই তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে ক্ষমতাবান বোধ করে। গার্হস্থ্য সহিংসতা মোকাবেলা এবং সংশ্লিষ্ট কলঙ্ক দূর করতে আইনি ও নীতিগত ব্যবস্থা সমানভাবে অপরিহার্য।

অবশেষে, গার্হস্থ্য সহিংসতা নিয়ে চর্চা বা আলোচনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি সচেতনতা বাড়ায়, সমস্যাটির চারপাশের নীরবতা ভাঙতে সাহায্য করে এবং ভুক্তভোগীদের সমর্থন চাইতে উৎসাহিত করে। এটি স্বাস্থ্যকর সম্পর্কের বিষয়ে শিক্ষার প্রচার করে এবং এই ধরনের ক্ষতিকর আচরণ প্রতিরোধে অবদান রাখে।

গার্হস্থ্য সহিংসতা একটি বিস্তৃত সামাজিক সমস্যা হিসাবে রয়ে গেছে, যা বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের কলঙ্কের ওজন দ্বারা বৃদ্ধি পায়।

এশীয় পরিবারগুলিতে গার্হস্থ্য সহিংসতার আশেপাশের কলঙ্কের অবসান ঘটাতে সাংস্কৃতিক নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করার, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সহায়তা প্রদানের জন্য একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। নীরবতা ভঙ্গ করে, শিক্ষার প্রচার করে এবং বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের ক্ষমতায়ন করে, আমরা এমন একটি সংস্কৃতি তৈরির দিকে কাজ করতে পারি যেখানে গার্হস্থ্য সহিংসতা সহ্য করা হয় না এবং ক্ষতিগ্রস্তদের নিরাময় ও ন্যায়বিচারের দিকে তাদের যাত্রায় সমর্থন দেওয়া হয়।

লন্ডন

০৭/১২/২০২৩


img

যুদ্ধ উত্তেজনায় ইরান-ইসরায়েল, কে জিতল, কে হারল?

প্রকাশিত :  ১১:৪৯, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৫৬, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

সিমন টিসডল

ইসফাহানের সামরিক ঘাঁটির কাছে ও অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুতে গত শুক্রবার আকাশপথে ইসরায়েল যে হামলা চালায়, ইরান সেটা ততটা পাত্তা দিতে নারাজ। বাইরে থেকে হামলার বিষয়টা তেহরান অস্বীকার করেছে। 

ইসরায়েলি মুখপত্ররা আর সব বিষয়ে অনর্গল বাক্যবর্ষণ করে চললেও এ ঘটনায় অদ্ভুতভাবে নীরব। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ঘটনাকে গুরুত্বহীন করে তুলতে দুই পক্ষের মধ্যে যেন একটা চুক্তি হয়েছে, যাতে ধীরে ধীরে উত্তেজনার পারদ এমনিতেই নিচে নেমে যায়।

এটিকে উনিশ শতকের সেই চোরাগোপ্তা কোনো এক ডুয়েল লড়াইয়ের মতো মনে হচ্ছে; যেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ইংরেজ ব্রিটেনে কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে তৃণভূমির মধ্যে পরস্পরের দিকে অবৈধভাবে পিস্তল তাক করেছে। ইরান ও ইসরায়েল দুই দেশেরই মানমর্যাদা পরিপূর্ণভাবে রক্ষা করতে হবে, কিন্তু সেটা আবার করতে হবে জনগণের মধ্যে যেন আবার চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু না হয়, সেটা মাথায় রেখে। 

দুই দেশই একে অন্যের দিকে সরাসরি হামলা করেছে। তাতে প্রতীকী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখন তারা এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে খেলা শেষ, অন্তত এবারের মতো।

এটা যদি সত্যি (যদিও সম্ভাবনাটা সাময়িক সময়ের জন্য) হয়, তাহলে সেটা অনেক বড় স্বস্তির বিষয়। এ ঘটনা এই ইঙ্গিত দেয় যে সংযত হতে ইসরায়েলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র চাপ (যুক্তরাজ্য ও অন্য দেশগুলোও তাতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে) কাজে এসেছে। 

গত সপ্তাহে ইসরায়েলে ইরানের অভূতপূর্ব ও বড় পরিসরে হামলার পর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলের প্রতি ‘জয়টাকে ধরে রাখার’ আহ্বান জানিয়ে ছিলেন। বোঝা যাচ্ছে, এই বার্তার মর্মোদ্ধার সফলভাবেই করতে পেরেছে ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের নেতৃত্ব কখনোই কোনো বিষয়ে পুরোপুরি ঐকমত্য হতে পারে না।

অবশ্য ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ডিএনএর মধ্যেই সংযমের বালাই নেই। সাবেক এই কমান্ডো ইরানের হামলার পর সহজাতভাবেই পাল্টা শক্তি দেখাতে চেয়েছিলেন। আর তাঁর কট্টর ডানপন্থী মিত্ররা যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল। 

এই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েল যে মাপা পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে মানাতে পেরেছে। আর ইরানের ড্রোন ও মিসাইল হামলা থেকে ইসরায়েলকে সুরক্ষা দিতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, সেটাও নেতানিয়াহুর পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

আবার ইসরায়েলের সামান্যতম উদ্‌যাপনের কোনো কারণ নেই। এটা ঠিক যে এবার ইসরায়েল ইরানের হামলা ঠেকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অজেয় বলে ইসরায়েলের যে সুখ্যাতি, সেটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ইসরায়েল অভেদ্য দুর্গ বলে যে মিথ, সেটা গুঁড়িয়ে গেছে। একইভাবে গাজায় এখনো হামাসের হাতে বন্দী ১৩০ পণবন্দী রয়ে গেছে। হামাস এখনো অপরাজেয়।

অবশ্য এখানেই বিষয়টা মীমাংসা হয়ে গেল এটা ধরে নেওয়াটাও বোকামি হয়ে যাবে। রাজনৈতিক ও মতাদর্শিকভাবে গভীর বৈরিতা ইরান ও ইসরায়েল—এই দুই শত্রুকে পরস্পর থেকে আলাদা করে রেখেছে। 

দুই দেশের সরকারের মধ্যেই অভ্যন্তরীণ বিভাজন রয়েছে, যা চরম অনিশ্চয়তা ও প্ররোচনাময় পরিবেশ সৃষ্টি করছে। তারই একটা ভয়ানক নজির আমরা গত কয়েক দিনে দেখতে পেলাম। একেবারে মুখোমুখি যুদ্ধের প্যান্ডোরার বাক্সটি সরাসরি খুলে গিয়েছিল।

বছরের পর বছর ধরে দুটি দেশ যে ছায়াযুদ্ধ লড়ে যাচ্ছিল, সেই যুদ্ধ তারা সবার চোখের সামনে দিনের আলোয় নিয়ে এসেছিল। ইরান দেখিয়ে দিয়েছে যে তারা ইসরায়েলের যেকোনো জায়গায়, যেকোনো সময়, প্রত্যক্ষভাবে হোক আর পরোক্ষভাবে হোক, হামলা চালাতে সক্ষম। আর ইসরায়েল দেখাল যে তারা যদি চায়, তাহলে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালাতে সক্ষম, পরেরবারের হামলা হবে আরও ভয়াবহ।

ইসরায়েল-ইরানের এ অচলাবস্থা ফিলিস্তিন সংঘাতের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। কিন্তু ফিলিস্তিন সংকট নিরসনে কোনো ভূমিকা রাখছে না। আর ফিলিস্তিন সংকটে পশ্চিমাদের দোটানা অবস্থান আগের চেয়ে তীব্র হলো। 

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন একপেশে, দ্বিমুখী নীতির প্রতীক হয়ে উঠলেন। গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছতে তিনি প্রাণান্ত চেষ্টা করে চলেছেন, কিন্তু যুদ্ধবিরতির চেষ্টায় সমানভাবে ঢিলেমি করে যাচ্ছেন। ফলে তাঁর নীতি খুব সামান্যই সফলতার মুখ দেখছে।

এর একটা কারণ হতে পারে, ঋষি সুনাকের সরকার ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র বিক্রির সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। আরেকটি কারণ হলো, ১ এপ্রিল দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলের বিমান হামলার (এই হামলায় ইরানের জ্যেষ্ঠ কয়েকজন কমান্ডার নিহত হন, ইসরায়েলে প্রতিশোধমূলক হামলা চালায় ইরান) নিন্দা জানাতে ক্যামেরন অস্বীকৃতি জানান।

জাতিসংঘ–বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের কনস্যুলেটে ইসরায়েলের হামলা ছিল আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। গত সপ্তাহে ক্যামেরন অবশ্য স্বীকার করেছেন, যুক্তরাজ্যের কোনো দূতাবাসে এ ধরনের হামলা হলে তারা কঠোর ব্যবস্থা নিত। 

কিন্তু তিনি কখনোই বলবেন না, ইসরায়েল অন্যায় করেছে। এ ধরনের ইসরায়েলপন্থী অবস্থান বেশির ভাগ পশ্চিমা দেশের সরকারগুলোর চারিত্রিক অবস্থান।

হারজিতের প্রশ্নটি বড় পরিসর থেকে বিবেচনা করা হলে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে গত সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহে ইউক্রেনীয়রাও সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা আরেকটি পশ্চিমা ভণ্ডামির শিকার। 

দুই বছরের বেশি সময় ধরে কিয়েভ ন্যাটোর কাছে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থা চেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের সেই চাওয়া বৃথা পর্যবসিত হয়েছে।

অথচ ইরান যখন ইসরায়েলে ড্রোন ও মিসাইল হামলা করল, তখন পশ্চিমা দেশগুলো তেল আবিবের সুরক্ষা দিতে কী না করেছে। ইরান ৩০০ ড্রোন ও মিসাইল ছুড়লেও প্রায় অক্ষত থাকে ইসরায়েল। অথচ প্রতি সপ্তাহে রাশিয়া সমানসংখ্যক ড্রোন ও মিসাইল হামলা করে ইউক্রেনে।  

একইভাবে অবরুদ্ধ গাজাবাসীর হতাশা আরও প্রলম্বিত হলো এ–ই দেখে যে নেতানিয়াহুর প্রতি পশ্চিমা সমালোচনা রাতারাতি পাল্টে গেছে। পশ্চিমাদের এই সংহতির ঐকতানের জন্য ইরান অবশ্যই নেতানিয়াহুর ধন্যবাদ পেতে পারে। 

দাতা সংস্থাগুলো ফিলিস্তিন নিয়ে অব্যাহতভাবে সতর্ক করে যাচ্ছে যে সেখানে দুর্ভিক্ষ আসন্ন। ইসরায়েলের হাতে ৬ মাসে ৩৪ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। রাফায় ভয়াবহ আগ্রাসন চোখরাঙানি দিচ্ছে। গাজা ও পশ্চিম তীরে কোনো বিজয়ী নেই, কেবল পরাজিত রয়েছেন।

ইরান দাবি করেছে, তারা খুব সফলভাবে দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে বোমাবর্ষণের শাস্তি দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ইরানের এই হামলাকে একটা পরাজয়ই বলা যায়। কেননা, এতে তাদের সামরিক সীমাবদ্ধতা প্রকাশ হয়ে গেছে। 

এ হামলার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ইরান আরও একঘরে হয়ে গেছে, তেহরানের ঘাড়ে নতুন নিষেধাজ্ঞার বোঝা চেপেছে এবং ফিলিস্তিনিদের সুবিধা হয়—এমন কোনো কিছু করতে পারেনি ইরান। অবশ্য সেটা তাদের নেতারা তোয়াক্কা করেন না।

আবার ইসরায়েলের সামান্যতম উদ্‌যাপনের কোনো কারণ নেই। এটা ঠিক যে এবার ইসরায়েল ইরানের হামলা ঠেকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অজেয় বলে ইসরায়েলের যে সুখ্যাতি, সেটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ইসরায়েল অভেদ্য দুর্গ বলে যে মিথ, সেটা গুঁড়িয়ে গেছে। একইভাবে গাজায় এখনো হামাসের হাতে বন্দী ১৩০ পণবন্দী রয়ে গেছে। হামাস এখনো অপরাজেয়।

অনেকের কাছেই শক্তিশালী যুক্তি হলো, মধ্যপ্রাচ্যের মূল সংকট সমাধান করতে হলে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের অবসান করতে হবে। এর জন্য অনেক বেশি কূটনৈতিক সময়, শক্তি ও সম্পদ ব্যয় করা প্রয়োজন। 

এই সংঘাত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় বিষ ছড়াচ্ছে। এই সংঘাত পশ্চিমা নীতিকে ভারসাম্যহীন করে তুলছে। ইরানের মতো দুর্বৃত্ত খেলোয়াড়ের ক্ষমতা বাড়াচ্ছে।


সিমন টিসডল: বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক ভাষ্যকার ও কলাম লেখক;
(গার্ডিয়ান থেকেঅনূদিত)

মতামত এর আরও খবর